রবিবার, ২৯ Jun ২০২৫, ১২:৩৯ অপরাহ্ন
মার্ক ওয়েন জোন্স:
গত কয়েকদিন ধরে ইসরায়েলি সেনাদের দ্বারা বিভিন্ন বয়সের ফিলিস্তিনি পুরুষ ও কিশোরদের লাইনে দাঁড় করানো, হাঁটুমুড়ে বসিয়ে রাখা কিংবা ট্রাকে করে তুলে নিয়ে যাওয়ার ছবি ও ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। ইসরায়েল দাবি করেছে, এরা সন্দেহভাজন হামাস যোদ্ধা, যাদের উত্তর গাজা থেকে বন্দি করা হয়েছে। একটি ভিডিওতে এমনও দেখা গেছে যে, অন্তর্বাস পরা একদল ফিলিস্তিনি আইডি কার্ড উঁচিয়ে হাঁটছে এবং রাস্তার পাশে একটি বন্দুক রেখে ‘প্রমাণ’ করেছে যে তারা আসলেই ‘জঙ্গি’। ভিডিওটি ভালোভাবে খেয়াল করে দেখলেই বোঝা যায়, এটা আসলে একটা নাটক, মিথ্যা বয়ানকে সত্য হিসেবে হাজির করার জন্য সাজানো চেষ্টা। ইসরায়েলি সৈন্যরা একদল সশস্ত্র যোদ্ধার সন্ধান পেয়ে তাদের অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে হাজির করবে তা বোধ হয় পাগলও বিশ^াস করবে না। কেবল তাই-ই নয়, কথিত যোদ্ধাদের বিচ্ছিন্ন করে তাদের সারিবদ্ধ করে দাঁড় করিয়ে ভিডিও বানাতে অপেক্ষা করবে আর সেটা হয়ে গেলে তাদের লাউড স্পিকারের মাধ্যমে তার অস্ত্র সমর্পণের নির্দেশ দেবে এবং আরবিতে ‘হাবিবি’ (আমার প্রিয়) বলে ডাকবে! ফিকশনেরও একটা মাত্রা থাকে…।
সে যাই হোক পরবর্তী সময়ে মিডিয়ায় প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, এইসব বন্দি ফিলিস্তিনিরা আশ্রয় নিয়েছিলেন উত্তর গাজায় বাস্তুচ্যুতদের আশ্রয়স্থল জাতিসংঘ পরিচালিত স্কুলে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী প্রথমে তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে যায়। এদের কয়েকজন জাতিসংঘের কর্মী, বেশ কয়েকজন হলেন স্বেচ্ছাসেবক এবং অন্তত একজনকে সাংবাদিক বলে চিহ্নিত করা গেছে। যাকে বন্দুক রাখতে বলা হয়েছিল, ধারণা করা হচ্ছে তিনি একজন দোকানদার।
‘বন্দুক সমর্পণ’র ভিডিওটি পশ্চিমা দর্শকদের সামনে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর অপরাধ ঢাকার আরেকটি মরিয়া প্রচেষ্টা হতে পারে। তবে বিভিন্ন বয়সী ফিলিস্তিনি পুরুষ ও কিশোরদের অপদস্থ করার ছবি ও ফুটেজ প্রকাশের উদ্দেশ্য ভিন্ন। ইসরায়েলি জনসাধারণের মনোবল বাড়ানোর পাশাপাশি ফিলিস্তিনিদের নিরাশ করাই এর প্রধান লক্ষ্য। এটি দখলদারিত্বের মতাদর্শের একটি সুস্পষ্ট প্রতিফলন, যেখানে ফিলিস্তিনিদের নির্দয়ভাবে হত্যার পাশাপাশি এসব ছবি দিয়েও পরাধীন ও নিপীড়িত জাতি হিসেবে দেখানো যায়। এই ছবি ও ফুটেজ প্রকাশ করছে যে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী পরিকল্পিতভাবে ক্রমবর্ধমান হারে ফিলিস্তিনি পুরুষদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে চলেছে এবং গাজায় তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাচ্ছে। বন্দিবিনিময়ের মাধ্যমে ইতিমধ্যে যারা মুক্তি পেয়েছেন, তারাও ইসরায়েলি সেনাদের হাতে নির্যাতন ও মারধরের বর্ণনা দিয়েছেন। অনেকের ভাগ্য এখনো অজানা। এরই মধ্যে কমপক্ষে ছয়জন ফিলিস্তিনি বন্দির মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া গেছে। বাকিরাও ব্যাপক নির্যাতনের মুখোমুখি হচ্ছে বলে জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত ভিডিও ও ছবিগুলো কয়েকজন আটককৃতকে শনাক্ত করতে সাংবাদিক ও সাহয্যকর্মীদের সাহায্য করেছে। একই সঙ্গে ইসরায়েলে সেনারা যে দাবি করেছে যে, আটককৃতরা হামাস যোদ্ধা, তা-ও মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়েছে। হানি আল-মাযুন, ইউএনআরডব্লিউএ-এর জন্য তহবিল সংগ্রহকারী মার্কিন দাতব্য সংস্থার একজন কর্মকর্তা, তিনি বলেছেন, আটকদের মধ্যে তিনি তার ভাই মাহমুদ, একজন দোকানদার এবং তার ২৭ বছর বয়সী ভাতিজা আবুদকে দেখেছেন। তিনি গার্ডিয়ানকে বলেন, তার বাবা ও ১৩ বছরের ভাতিজা ওমরকেও আটক করা হয়েছে। দিয়া আল-কাহলুত, দ্য নিউ আরব-এর একজন সংবাদদাতা, যাকে তার ভাইদের সঙ্গে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়, ভিডিওতে দেখে তার সহকর্মীরা তাকে চিনতে পেরেছেন। সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছে, ইসরায়েলি সৈন্যরা প্রথমে তাদের বাড়িতে আটকে রাখে এবং বাড়িতে আগুন দেওয়ার আগে তাদের স্ত্রী ও সন্তানদের বের করে দেয়।
এই ধরনের অপমানজনক চিত্র প্রকাশ করা জেনেভা কনভেনশনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং ‘নিষ্ঠুর আচরণ ও নির্যাতন’ এবং ‘ব্যক্তিগত মর্যাদার ওপর আক্রোশ’, বিশেষ করে অপমানজনক ও অবমাননাকর। এ ধরনের আচরণের বিষয়ে পরিষ্কার আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এইসব ছবি ও ভিডিও বিশ্বব্যাপী ক্ষোভের সঞ্চার করেছে। এসব ইসরায়েলি কর্মকা-ের তুলনা করা হচ্ছে মার্কিন ‘রেন্ডিশন’ প্রোগ্রাম এবং ইরাকের আবু গারিব কারাগার ও গুয়ানতানামো ডিটেনশন সেন্টারের নির্যাতনের সঙ্গে। এসব বসনিয়া যুদ্ধে সার্ব মিলিশিয়াদের পরিচালিত গণহত্যা ও নির্যাতনের ঘটনাগুলোর সঙ্গেও তুলনা করা যায়। ইসরায়েলের অভ্যন্তর থেকেও এহেন আচরণের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত ইসরায়েলি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শ্লোমো ব্রম এনপিআরকে বলেছেন, ছবিগুলো অপমানজনক, এগুলো প্রকাশ করা উচিত হয়নি। বিষয়টি যদি এমনই হয় অর্থাৎ, এই ছবি ও ফুটেজ প্রকাশ যদি গাজায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর আরেকটি অপরাধ হয়ে থাকে, তাহলে কোনো উদ্দেশ্যে তারা সেসব সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়েছে? ব্রমের মতে, উদ্দেশ্য হলো, ইসরায়েলের মনোবল বাড়ানো এবং ‘হামাসের বিরুদ্ধে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ’ চালানো।
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘর্ষের প্রেক্ষাপটে এমন পদ্ধতিগত অপমান নতুন কিছু নয়। ফিলিস্তিনি বুদ্ধিজীবী রামজি বারুদের মতে, ‘ফিলিস্তিনিদের অপমান করাই ইসরায়েলের প্রকৃত নীতি।’ হারেৎজের সংবাদদাতা আমিরা হাস ইসরায়েলি কারাগারে ফিলিস্তিনি বন্দিদের অপমানকে একটি ‘রুটিন কৌশল’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
এই ছবি ও ফুটেজ প্রকাশের পর বিশ্বের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হচ্ছে যে, ফিলিস্তিনিদের প্রতিদিনের অপমান এর আগে বাকি বিশ্বের নজরে পড়েনি! যদিও আজকাল সারা বিশ্বেই ফিলিস্তিনিদের প্রতি অবমাননাকর আচরণ দেখা গেছে। ডিজিটাল প্রযুক্তি কেবল অপমানজনক ঘটনাগুলো ভাইরাল হতে সাহায্য করেছে। ৭ অক্টোবর থেকে ভাইরাল হওয়া বিভিন্ন ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, ইসরায়েলি সৈন্যরা আক্রান্ত ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘরে মলত্যাগ করছে, ফিলিস্তিনি দোকানে ঢুকে খেলনা ভাঙছে এবং হাসছে, ফিলিস্তিনি বন্দিদের গালাগাল করছে। ‘হামাস যোদ্ধা’ প্রমাণ করতে সম্প্রতি ফিলিস্তিনিদের অর্ধনগ্ন যে ভিডিওগুলো প্রকাশ করা হয়েছে, তা তাদের অপমানকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে বৈকি। গ্রেপ্তার করা আর অবমাননাকর আচরণ করার চিত্র প্রচার করা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। কেননা, এই ধরনের চিত্র সম্প্রচার করার ফলে অপমান কেবল সেই সময়টিতে কিংবা সরাসরি জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং তা সর্বজনীন সর্বকালীন প্রদর্শনে পরিণত হয় এবং দীর্ঘকাল ধরে লাখ লাখ মানুষ দেখতে থাকে।
মানুষের যন্ত্রণাকে স্থায়ী করার ক্ষেত্রে ফটোগ্রাফির ভূমিকা কেমন, এ বিষয়ে মার্কিন বুদ্ধিজীবী সুসান সোনট্যাগের পর্যবেক্ষণ এখানে বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেছেন, ‘ফটোগ্রাফি একটি ঘটনা বা ব্যক্তিকে এমন বস্তুতে পরিণত করে, যা ইচ্ছামতো ব্যবহার করা সম্ভব।’ এইসব ফটোগ্রাফিও এখানে একই কাজ করছে। ক্ষতিগ্রস্তদের আপত্তিকর অবস্থায় পরিবেশন করা হচ্ছে, ছবিগুলো তাদের মর্যাদা হ্রাস করছে এবং দীর্ঘস্থায়ী অমানবিক পরিস্থিতিতে ফেলে দিচ্ছে। এই ধরনের অবজেক্টিফিকেশন শিকার বা ক্ষতিগ্রস্তদের স্বকীয়তা ও সম্মান কেড়ে নেয়, তাদের অপমানের প্রতীকে পরিণত করে। এর ফলে ভুক্তভোগী ফিলিস্তিনিরা পরবর্তী সময়ে আরও অমানবিক পরিস্থিতিতে পড়তে পারে এবং ‘অন্য’ ফিলিস্তিনিদেরও ইসরায়েলি জনসাধারণ এবং বাকি বিশ্বের সামনে নীচু করে তোলার প্রচেষ্টা হিসেবে কাজ করতে পারে। ফিলিস্তিনি জনগণকে এভাবে ‘ঊনমানুষ’ হিসেবে উপস্থাপন করা এবং তাদের গণহত্যাকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য এসব অমানবিক তৎপরতা বিশ্বব্যাপী ইসরায়েলি প্রচারণার অংশ এবং নিয়মিতই তারা এটা চালিয়ে যাচ্ছে। এই ছবি ও ভিডিওগুলো শুধুমাত্র অপমানজনক কাজের রেকর্ড নয়; বরং এগুলোর অপব্যবহারের প্রভাব ভয়ংকর। ব্যক্তি যন্ত্রণার মুহূর্তগুলো একটা সময় জনসাধারণের দর্শনে রূপান্তরিত হয়, ফলে ভুক্তভোগী ও স্বজাতির ওপর আঘাতের মানসিক ক্ষত গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে।
মোট কথা, এসব ছবিতে আসলে হামাসকে অপমান করা হয়নি, বরং সমস্ত ফিলিস্তিনিকে অপমান করার জন্যই করা হয়েছে, সর্বাধিক দর্শকদের সামনে ফিলিস্তিনিদের ‘ঊনমানুষ’ হিসেবে তুলে ধরতে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
আলজাজিরা থেকে ভাষান্তর : মনযূরুল হক
লেখক: মার্ক ওয়েন জোনস হামাদ বিন খলিফা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যপ্রাচ্য স্টাডিজ এবং ডিজিটাল মানবিক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক
ভয়েস/আআ